তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল: গভীর রাত্রির ইবাদতের ফজিলত ও বিধান
তাহাজ্জুদ নামাজ ইসলামে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি ইবাদত। মুসলিম সমাজে এর ফজিলত, গুরুত্ব এবং আত্মশুদ্ধিতে এর প্রভাব নিয়ে বহু আলোচনা রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি প্রশ্ন প্রায়ই দেখা যায়—তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল? এই প্রশ্নের উত্তর জানার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারব ইসলামে এর অবস্থান, গুরুত্ব ও উপকারিতা কী।
তাহাজ্জুদ নামাজের অর্থ ও সময়
“তাহাজ্জুদ” শব্দের অর্থ হলো “রাতের ঘুম ভেঙে ওঠা”। অর্থাৎ এই নামাজ সেই সময় আদায় করা হয়, যখন মানুষ সাধারণত ঘুমিয়ে থাকে—অর্থাৎ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে। এটি রাতে ঘুম থেকে জেগে, অজু করে দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে পালন করা হয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের নির্দিষ্ট সময় শুরু হয় এশার নামাজের পর থেকে ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। তবে সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে রাতের শেষ ভাগ। রাসূল (সা.) স্বয়ং এই সময় নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন, যা প্রমাণ করে এর মাহাত্ম্য কতটা।
কুরআনে তাহাজ্জুদ নামাজের উল্লেখ
আল-কুরআনের বহু আয়াতে রাতের ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। বিশেষত সূরা আল-ইসরা (১৭:৭৯) আয়াতে বলা হয়েছে:
“আর রাতে কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় কর; এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে ‘মাকাম মাহমুদ’-এ (প্রশংসিত স্থানে) পৌঁছে দেবেন।”
এই আয়াতকে কেন্দ্র করে অনেক আলেমের অভিমত হলো, রাসূল (সা.)-এর জন্য তাহাজ্জুদ ছিল “ওয়াজিব” বা অপরিহার্য। কিন্তু সাধারণ উম্মতের জন্য এটি “নফল” ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়।
হাদীসে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রাতের নামাজ সর্বোত্তম ইবাদতের একটি। তোমরা তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর; কারণ সেই সময়ে আল্লাহ সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকেন।” (মুসলিম শরীফ)
তাহাজ্জুদের মাধ্যমে একজন মুমিন ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নির্জনতা, নিঃশব্দতা ও পরিপূর্ণ একাগ্রতায় এই নামাজ আত্মিক প্রশান্তির অসাধারণ মাধ্যম।
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল: ফিকহ মতে ব্যাখ্যা
এখন মূল প্রশ্নে আসা যাক—তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল? অধিকাংশ ইসলামি চিন্তাবিদ ও চার মাজহাবের ইমামগণ একমত যে, তাহাজ্জুদ নামাজ “নফল” ইবাদতের অন্তর্গত। এটি ফরজ বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা নয়।
তবে কিছু আলেমের মতে, যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করেন, তাদের জন্য এটি এক ধরনের “মুআদাব” (অভ্যাসগত ইবাদত), যা ছেড়ে দেওয়া অনুচিত। অর্থাৎ, এটি ইবাদতের এমন একটি স্তর যা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং অভ্যাসে পরিণত করলে ত্যাগ করা উচিত নয়।
হানাফি মাজহাবে দৃষ্টিভঙ্গি
হানাফি মাজহাবের মতে, তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নয় বরং “মুস্তাহাব” (প্রশংসনীয়)। অর্থাৎ এটি আদায় করলে সওয়াব পাওয়া যায়, তবে না করলেও গুনাহ হবে না।
শাফেয়ি ও মালিকি মত
শাফেয়ি ও মালিকি মাজহাবেও একই রকম মত বিরাজমান। তবে তারা জোর দিয়ে বলেন, এটি ঈমানদারদের মানসিক ও আত্মিক উন্নয়নের জন্য খুবই উপযোগী এবং নিয়মিত পালনীয়।
তাহাজ্জুদের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি
তাহাজ্জুদ নামাজ সাধারণত ২ রাকাত করে আদায় করা হয় এবং সর্বোচ্চ ৮ অথবা ১২ রাকাত পর্যন্ত আদায় করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ এবং শেষে ৩ রাকাত বিতর নামাজ আদায় করতেন। কেউ চাইলে শুধু ২ রাকাতও আদায় করতে পারে।
তাহাজ্জুদের নিয়ত
নিয়ত: “আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের ২ রাকাত আদায় করছি, কিবলামুখী হয়ে, আল্লাহু আকবার।”
কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া
এই নামাজে দীর্ঘ কিরাত ও তিলাওয়াত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া সিজদার মধ্যে নিজের ইচ্ছেমত দোয়া করা যায়, যা অত্যন্ত ফলদায়ক বলে বিবেচিত।
তাহাজ্জুদের উপকারিতা
তাহাজ্জুদ নামাজ শুধু একটি নফল ইবাদত নয়; এটি আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি অপূর্ব পথ। এর উপকারিতা শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক—তিনটি দিক থেকেই একজন মানুষকে আলোকিত করে। এমনকি যারা প্রতিদিন তাহাজ্জুদ আদায় করেন, তাদের ব্যক্তিত্বে দেখা যায় আত্মবিশ্বাস, সংযম এবং স্থিরতা।
প্রথমত, তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল এই প্রশ্নের উত্তর যেমন ইসলামী দৃষ্টিতে স্পষ্ট, ঠিক তেমনি এর ফজিলতও অস্বীকার করার মতো নয়। এই নামাজ আদায় করতে হলে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে অজু করে নামাজে দাঁড়াতে হয়—এটি কোনো সাধারণ অভ্যাস নয়। এটি আত্মনিয়ন্ত্রণের চরম নিদর্শন। একজন মুমিন যখন ঘুম ত্যাগ করে তাহাজ্জুদের জন্য জেগে ওঠে, তখন তার ইচ্ছাশক্তি এতটাই দৃঢ় থাকে যে তা সকল কাজে প্রভাব ফেলে।
দ্বিতীয়ত, এই নামাজ মানসিক চাপ কমাতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে। দিনভর দুশ্চিন্তা, ব্যর্থতা বা অশান্তি যদি কেউ হৃদয়ে বহন করেন, তাহাজ্জুদের মাধ্যমে তা নিরসন সম্ভব। রাতের একান্ত নীরবতায় সিজদায় পড়ে কান্না করা—এটি একপ্রকার মানসিক থেরাপির মতো কাজ করে। অনেক সময় মুমিনের চোখের পানি, রাতের অন্ধকারে, আল্লাহর দরবারে নিজের কষ্ট উজাড় করে দেওয়াই মনকে হালকা করে দেয়।
তৃতীয়ত, তাহাজ্জুদের অন্যতম ফজিলত হলো—আল্লাহর নৈকট্য লাভ। হাদীসে আছে, আল্লাহ রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন: “কোনো বান্দা কি আছে যে দোয়া করবে, আর আমি তা কবুল করব?” এই মুহূর্তে দোয়া করলে তা বেশি কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
চতুর্থত, যারা জীবনের লক্ষ্যপূরণ, দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ বা নিজের ও পরিবার-পরিজনের জন্য দোয়া করতে চান, তাহাজ্জুদ তাদের জন্য এক অতুলনীয় সুযোগ। অন্য কোনো নামাজে এতটা ঘনিষ্ঠতা ও সরাসরি সংলাপ আল্লাহর সঙ্গে গড়ে তোলা যায় না।
সবশেষে বলা যায়, তাহাজ্জুদ একজন মানুষকে এমনভাবে বদলে দিতে পারে, যা দিনের আলোতেও সম্ভব হয় না। এটি বিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ককে দৃঢ় করে। যে কেউ যদি নিয়মিত এই ইবাদত শুরু করে, তার মধ্যে আলাদা প্রশান্তি, ধৈর্য এবং আধ্যাত্মিক শক্তি দেখা যাবে, যা সাধারণত অন্য কোনো মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়।
তরুণ সমাজ ও তাহাজ্জুদের গুরুত্ব
তরুণরা আজ প্রযুক্তির ব্যস্ততায়, নানান দিকভ্রান্তিতে সময় ব্যয় করে। তাহাজ্জুদ তাদেরকে শান্তির দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। এটা একধরনের আত্মানুশীলন, যা আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক পথের দিশা দেয়।
যদি আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রতিদিন শুধু ২ রাকাত করে তাহাজ্জুদ আদায় করার অভ্যাস গড়ে তোলে, তবে তাদের জীবনে একটি অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিরতা সৃষ্টি হবে।
নারীদের জন্য তাহাজ্জুদের ফজিলত
নারীরা ঘরে বসেই সহজভাবে তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারেন। তাঁদের জন্য এই নামাজ আরও সহজ এবং ফলদায়ক, কারণ তারা সাধারণত নির্জনে ইবাদত করতে সক্ষম হন। তাহাজ্জুদ নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং ঘরোয়া জীবনের মধ্যে আত্মিক পরিপূর্ণতা এনে দেয়।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণে তাহাজ্জুদের ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাস ও আধ্যাত্মিক চর্চায় তাহাজ্জুদের একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। এটি শুধু একটি নফল নামাজ হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়—বরং একজন মুমিনের আত্মিক জাগরণ ও আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার অন্যতম মাধ্যম। তাহাজ্জুদের গুরুত্ব বোঝাতে গেলে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইসলামের নবুয়তের আগেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) পাহাড়ের গুহায় ধ্যান ও আত্মশুদ্ধির জন্য নির্জনে সময় কাটাতেন। তিনি তখনো নবুয়তের ঘোষণা পাননি, কিন্তু তাহাজ্জুদের মতো রাতের ইবাদতের মাধ্যমে আত্মিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল—এই প্রশ্নের বাইরেও এর গুরুত্ব রয়েছে আত্মশুদ্ধির ও রূহানিয়াতের দিক থেকে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) নবুয়ত লাভের পর তাহাজ্জুদের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং তা নিয়মিত আদায় করতেন। কোরআন শরীফের সূরা আল-মুজাম্মিল-এ আল্লাহ তাআলা তাঁকে রাতের নামাজে দাঁড়াতে বলেন, যা তাঁর নবুয়তের শক্তি জোগান হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ইবাদতের মাধ্যমে নবীজি (সা.) কেবল নিজের ইমান ও ধৈর্য বাড়াননি, বরং উম্মতের জন্য একটি উদাহরণ তৈরি করেছেন।
তাহাজ্জুদের গুরুত্ব শুধু রাসূলের জীবনে সীমাবদ্ধ ছিল না। ইসলামের ইতিহাসে যারা ওলি-আউলিয়া, তাফসিরকারক, হাদীসবিদ, কিংবা সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছেন—তাঁদের জীবনের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল তাহাজ্জুদের অভ্যাস। তারা জানতেন, দিনের কাজের সফলতা নির্ভর করে রাতের ইবাদতের ওপর। এমনকি ইমাম গাজ্জালী, ইবনে তাইমিয়া, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বাল—এসব মনীষীরাও তাদের আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস হিসেবে তাহাজ্জুদের কথা উল্লেখ করেছেন।
FAQ
প্রশ্ন ১: তাহাজ্জুদ নামাজ কি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ?
না, তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ নয়। এটি একটি নফল নামাজ, তবে তা সুন্নত মুয়াক্কাদা হিসেবে প্রিয় নবী (সাঃ) নিয়মিত আদায় করতেন।
প্রশ্ন ২: তাহাজ্জুদ নামাজ কখন পড়তে হয়?
রাতের ঘুম থেকে জেগে ফজরের আগে যেকোনো সময় তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়। রাতের শেষ তৃতীয়াংশ সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ সময়।
প্রশ্ন ৩: তাহাজ্জুদের রাকাত সংখ্যা কত?
সাধারণত ২ থেকে ১২ রাকাত পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যায়। রাসূল (সাঃ) অনেক সময় ৮ রাকাত আদায় করতেন।
প্রশ্ন ৪: তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য বিশেষ কোনো দোয়া আছে কি?
হ্যাঁ, তাহাজ্জুদের সময় ব্যক্তিগত যেকোনো দোয়া করা যায়। আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত, হিদায়াত, রিজিক, শান্তি—সবকিছুর জন্য দোয়া করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৫: কেউ যদি ঘুম থেকে উঠতে না পারে, তাহলে কি তাহাজ্জুদের সওয়াব পাবে না?
যদি কেউ নিয়ত করে এবং ঘুম থেকে উঠতে না পারে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়তের জন্য সওয়াব দেওয়া হয়। তবে নিয়মিত চেষ্টা করতে হবে উঠার।
উপসংহার
তাহাজ্জুদ নামাজ এমন একটি ইবাদত যা কেবল নিয়মিত নামাজ আদায় নয়, বরং জীবনের গতিপথকেও আল্লাহর দিকে মোড় নেয়। প্রশ্নটা অনেকের মনে জাগে—তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল? এক কথায় উত্তর: এটি নফল নামাজ, তবে প্রিয় নবী (সা.) এর অন্যতম প্রিয় ইবাদত। এই ইবাদতকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করলে, আত্মিক শান্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি—দুটোই অর্জিত হয়।